ভালোবাসা তুমি বহুরূপী

সারওয়ার চৌধুরী:
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:১৫:৪০,অপরাহ্ন ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১মেয়ে বন্ধুর ভাগ্যটা কিন্তু আমার বরাবরই মন্দা! A -Z সব ধরনের ভিটামিন শূন্যতার প্রচণ্ড দখল ছিল শরীরে, চেহারাখানা তো আর শরীরের বাইরে নয় তাই সেই ভিটামিন শূন্যতার বিচরণ সেখানেও ছিল প্রখর।
সবে অনার্সে ভর্তি হয়েছি, প্রতিবেশী ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়েকে খুব ভাল লাগতো, তাকে দেখলেই শরীরে কি রকম একটা ভালোলাগার পরশে আমার প্রতিটা পশমে দোলা দিত অন্যরকম পুলক! ভাললাগার এই কথাটা মেয়েটাকে বলব বলব করে আর বলা হয়ে উঠেনি কারণ, ঐ যে ভিটামিনের শূন্যতাজনিত সাহসের তীব্র ঘাটতি! অনেকবারই চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি, ওর সামনাসামনি যত বারই যেতাম, গলাটা শুকিয়ে যেতো, বাকশক্তি যেনো হারিয়ে ফেলতাম! তবে আমার সহপাঠি ছেলেদের অনেকেই তার সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলো, হেসে হেসে কথা বলতো, আমি একটু দূর থেকে আমার নার্ভগুলোর সাথে যুদ্ধ করতাম আর নিস্তেজ পদার্থের মতো আড় চোখে চেয়ে চেয়ে শুধুই দেখতাম!
আমার মতো অনেকেরই হয়তো স্বপ্ন কন্যা ছিল সে, পরে জেনেছি ও নাকি অন্য কলেজের একটা ছেলেকে ভালোবাসে। তবে হৃদয়ঘটিত কিছু না হলেও পরবর্তীতে আমাদের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিলো। কিছুদিন পরে ওর বিয়ের দাওয়াত পেয়েছিলাম, সে তার ভালোবাসার মানুষকেই বিয়ে করে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছলো! ঐ পর্যন্তই, আর কিছু জানবার সময় সুযোগ হয়ে ওঠেনি, আমি আমার মতোই জীবন বাস্তবতায় ডুবে গেলাম।
পেরিয়ে গেছে আড়াই দশকেরও বেশি, জীবনের বাঁকে বাঁকে জমেছে অনেক স্মৃতি, অভিজ্ঞতা! প্রায় স্মৃতির অতলেই হারিয়ে গিয়েছিলো একটা সময় প্রচণ্ড ভালোলাগার সেই মুখখানা, অনেক যুবকের স্বপ্নে বিচরণ করা সেই লাস্যময়ী রাজকন্যা!
গতবার যখন টরেন্টোতে গেলাম, সেখানকার এক বাংলা পাড়ায় আমার এক বন্ধুর রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছি, তারপর যাকে দেখলাম, আমি পুরোপুরি স্তব্ধ, বাকহীন! আমার সেই স্বপ্নকন্যা, আমার মতো অনেকের হৃদয় তোলপাড় করা সেই মেয়েটি খাবার হাতে আমার টেবিলের সামনে! কিন্তু এ কি হাল? মুখখানা শুস্ক, বয়সের চাপ স্পষ্ট, সেই হাসি নেই, কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ! আমি তাকে ঠিকই চিনলাম, শতভাঁজে ছিন্নভিন্ন হলেও আমি তো এই চেহারা ভুলতে পারি না, তবে সেও আমাকে চিনেছে কি না, বুঝতে পারছিলাম না! আমার মধ্যে কিন্তু যৌবনের সেই ভিটামিন শূন্যতার জড়তা এখন আর নেই, ওর নাম ধরেই জানতে চাইলাম — কেমন আছো তুমি?
ও হয়তো মনে করেছিল আমি তাকে চিনতে পারবো না, মুহূর্তেই ওর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো, কোন কথা না বলেই আমার সামনে থেকে চলে গেল, আর আসলো না।
হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনায় আমিও কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়, রেস্টুরেন্টের মালিক বন্ধুটির কাছে ওর বিষয়ে জানতে চাইলাম! বন্ধুটি আমাকে রেস্টুরেন্টের বাইরে নিয়ে গেল, তুমি এই মহিলার বিষয়ে এতো ইন্টারেস্টেড কেন!
আমার কাছ থেকে সবকিছু শোনার পর সে বলতে লাগলো —-
– ও আমার রেস্টুরেন্টে কাজ করে, বছর তিনেক আগে ওর স্বামী তিন তিনটা ছেলেমেয়ে সহ ওকে এখানে রেখে দেশে গিয়ে নিজের সন্তানের বয়েসী আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করেছে, এখানে ফিরে এসে তাকে ডিভোর্স দিয়েছে! মহিলা এখন একাই তিন সন্তানকে নিয়ে খুব কষ্টের মাঝে আছে, মাসহ বাচ্চারা কি রকম একটা জড়তা আর লজ্জায় সব সময় আড়ষ্ট থাকে।
বন্ধুর কথা শোনার পর নিজের ভেতরে অন্য রকম একটা যন্ত্রণা যনো আমার সারা শরীরটাকে ধুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছিল, পুরুষ লোকটার কি সন্তানের প্রতি কোন ভালোবাসা নেই, দায়িত্ববোধ নেই! এই মহিলা স্বামী প্রত্যাখাত হওয়ার পর সুযোগ থাকা স্বত্তেও শুধুমাত্র সন্তানদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে নতুন কোন স্বপ্ন দেখছে না, নিজের সাধ আহলাদ অবলীলায় বিসর্জন দিতে একবারও কুন্ঠা করছে না, সেখানে আমরা পুরুষরা কি অবলীলায় সবকিছু ভুলে, দায়িত্ব কর্তব্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, স্নেহ মায়া মমতাকে অবহেলা করে স্বার্থপরের মতো মজে যাই অরুচিকর ভোগ ভালবাসায়।
আমি হাঁটছি আর ভাবছি, অনেক ছেলেই যাকে পেলে নিজেকে ধন্য মনে করতো, তার জীবনটা এই সময়ে এইভাবে ভালবাসাহীন হয়ে শূন্য হয়ে গেলো— এটা কি নিয়তি? যে ছেলেটা যৌবনে তাকে সারা জীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, অনেকের ভালোলাগার মানুষটাকে একান্ত নিজের করে নিয়েছিলো, সেই ভালবাসার মানুষের প্রতি এই অসময়ে এ কেমন অবিচার, অবহেলা?
সবাই কি জীবনে আসলেই প্রকৃত ভালবাসা পায় ? নাকি ভালবাসার নামে চলে অভিনয়, শুধুই অভিনয়। মনের অজান্তেই প্রশ্ন জাগে, কি করে চিনবো তোমায়, হে ভলোবাসা? ভালবাসা তুমি বহুরূপী, তোমার কারণে মানুষ হাসে, তোমার কারণে কাঁদে আবার তোমার কারণেই কারও জীবন হয়ে উঠে যন্ত্রণাময়, বিষাদগ্রস্ত।