আমাদের ভারতবিরোধী আন্দোলন ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

শাহ আবু আনাছ
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:৫৭:২০,অপরাহ্ন ২৮ মার্চ ২০২১- 12Shares
উনারা আন্দোলন করছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী বাংলাদেশে আসার প্রতিবাদে। মোদীকে দাঙ্গাবাজ, মুসলিম নিধনকারী ইত্যাদী বলে তারা দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করেছেন। হেফাজতের ব্যানারে সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও মাওলানারা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তারা হরতাল পালন করতে গিয়ে ব্যাপক সহিংসতা ঘটিয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছে হেফাজতের সমর্থকরা। এ সময় স্থানীয় প্রেসক্লাবে ও কালিবাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। সাংবাদিকসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন।
জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন শোভনের বাড়ি, সভাপতি রবিউল ইসলাম রুবেলের বাড়ি, জেলা পরিষদ ভবন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা এবং ধীরেন্দ্রনাথ ভাষা চত্বরের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে আগুন, আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর ও আগুন, মুক্তমঞ্চে আগুন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব ভাঙচুর, কালীবাড়ি মন্দিরের প্রতিমা, ব্যাংক এশিয়ার ফটকে ভাঙচুর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন ভাঙচুর করেছে তারা। হরতাল সমর্থকরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামির ওপরও হামলা চালিয়েছে। আশুগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝখানে ১৮ নম্বর রেল সেতুতেও আগুন দেওয়া হয়।
মাথায় রাখতে হবে আমরা কিন্তু একটি ধর্মীয় সংগঠনের আন্দোলন দেখছি। সহিংসতায় ভরা এই আন্দোলন কি ধর্ম সমর্থন করছে? ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ কি ধর্ম সমর্থন করে? কালিবাড়িতে প্রতিমা ভাংচুর করা হবে কেন? কেন প্রেসক্লাব তছনছ? এই দুই প্রতিষ্ঠান কি সরকারের অংশ? তা আমার বোধগম্য নয়।
নরেন্দ্র মোদী যদি মুসলমান নীপিড়ন করে থাকেন সেটা তার দেশে, এদেশে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রিয় মেহমান। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধকালিন সময়ে ভারতের সহায়তা বিবেচনা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে দাওয়াত করেছে। এখানে কে প্রধানমন্ত্রী তা মুখ্য নয়। কিন্তু হুজুররা সেই রাষ্ট্রিয় অতিথিকে নিয়েই রাজনীতিতে মেতেছেন। ভারত যদি আগামীকাল বাংলাদেশের সাথে সবধরণের চুক্তি অস্বীকার করে তবে এদেশে অনেকের চুলায় হাড়ি বসবে না। আমরা ভারতের আমদানীর উপর অনেকটাই নির্ভরশীল।
আমরা চাই, পেয়াজের মূল্যবৃদ্ধি রুখতে ভারত আমাদের যথেষ্ট পেয়াজ দেবে, চাল দেবে, রান্নার গ্যাস দেবে, মরিচ দেবে। এমনকি কোরবানীর সময়ে কমটাকায় বড় গরু দেবে। যদি তা না দেয় তবেই শুরু করি গালাগাল। যেনো ভারতকেই সব দিয়ে আমাদের অভাব পুরণ করতে হবে। দেশের বাজারে পেয়াজের মূল্য বাড়লে সবাই ভারতেই গালি দেয়, আবার দেশী চিনি বিক্রি না হলে ভারতের চিনিকেই দায়ী করে। এ যেন যত দোষ-নন্দ ঘোষ। ভারতের থেকে আমরা সবকিছু আশা করবো আবার তার প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান দেবো না-এটা কেন!
নরেন্দ্র মোদী মৌলবাদী। তিনি ভারতে অনেক মসজিদ ধ্বংস করেছেন-মানলাম তিনি তেমন দোষে দোষী। তবে আজ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কালিমন্দিরে প্রতিমা ভাংচুর কেন? ইসলামতো সংযমের ধর্ম , ইসলামতো শান্তির ধর্ম । এই ধর্মের নাম নিয়ে প্রতিমা ভাংচুর করা হবে কেন? কেন গুটি কয়েক মানুষের জন্য পুরো ইসলাম কলঙ্কিত হবে? তাহলে মোদীর সাথে আমাদের তাফাৎ থাকলো কই?
প্রেসক্লাব ভাংচুর কেন? কেন প্রেসক্লাব সভাপতি আহত? সাংবাদিকরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে সবার কাছে সংবাদ পৌঁছে দিতে দিনরাত খেটে মরছেন। হেফাজত বলেন আর যে কোন সংগঠন বলেন তাদের কর্মসূচী সাংবাদিকদের মাধ্যমেই সাধারণ মানুষ জানতে পারে। কিন্তু যারা এহেন কর্ম করলেন তারা কতোটুকু মানবিক বোধ সম্পন্ন সে প্রশ্ন থেকে যায়।
ভারতে প্রতিবছর যত মানুষ যায় তার মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা সর্বাধিক। বাংলাদেশীদের বৃহৎ অংশ ভারতে যায় চিকিৎসা করাতে। হেফাজতের সাবেক শীর্ষ আমীর আল্লামা শফিও ভারতে গিয়েছিলেন চিকিৎসা করাতে। যে দেশের উপর এত রাগ সে দেশে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সময় পোষে রাখা রাগ থাকে কোথায়? তখনওতো মোদীই ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায়। যাদের বাড়ির কাঁচামরিচ না হলে সিদ্ধভাতও মুখে যায় না, যাদের বাড়ি চিকিৎসা না করালে প্রাণ বাঁচে না তাদের উপর রাগ দেখানোর আগে নিজেদের সক্ষমতা চাই।
মিয়ানমানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও পদ্ধতিগত গণহত্যা চলার পর প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ২০১৮ সালে সে দেশের সমাজকল্যাণমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেন। তখনতো কোন হুজুরকে মিয়ানমারের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হতে দেখা যায়নি। ভারত সরকার যদি যদি ২-৫ হাজার মুসলিমকে নিধন করেন তবে মিয়ানমার লাখ লাখ মুসলিমকে হত্যা করেছে। ১০ লাখ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তারপরওতো সে দেশের সমাজকল্যাণমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরের সময় হুজুরদের আন্দোলন চোখে পড়েনি।
জানি না কেন-ভারতের প্রতি হুজুরদের এতো রাগ। সেটা কি ভারতের মুসলিম নিধন নাকি অন্যকিছুও এতে জড়িত-সে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ, পাকিস্তানীদের কিছু দোসর এখনও যে এই প্রজন্মের মাথা ক্রমাগত ওয়াশ করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সংবিধান কাটাকুটি, ক্রমাগত ভারত বিদ্বেষে মনে ভয় জাগে-পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা কি আবারো খামচে ধরছে আমাদের স্বাধীনতা!
লেখক: বেলজিয়াম প্রবাসী।
- 12Shares