অপেক্ষার দশ বছর

সুবের আহমদ :
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:০৯:০৬,অপরাহ্ন ১৮ এপ্রিল ২০২২এ যেন অন্তহীন এক অপেক্ষা। যার প্রহর গুনতে গুনতে যেন চোখের পলকেই কেটে গেল দশ দশটি বছর। এখনো নিজের কাছে বিশ্বাস হয়না যে তিনি নিখোঁজ। এমন জনদরদী নেতাকে নিখোঁজ করা হতে পারে কল্পনায়ও আসেনি কোনদিন। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে আজ ২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল মধ্যখানে অতিবাহিত হলো দশ দশটি বছর। আজও কোন খোজঁ মিললো না সিলেটের অবিসংবাদিত নেতা, জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক, সিলেট ২, বিশ্বনাথ বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগরের সাবেক নন্দিত ও সফল সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীর, সিলেটবাসীর প্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলীর, জনগণের নেতা এম ইলিয়াস আলীর। এর চেয়ে নিষ্ঠুর এবং বেদনার আর কি হতে পারে, একজন জীবন্ত মানুষকে এভাবে গুম করে দেওয়া হলো।
কী অপরাধ ছিল তাঁর? কী অপরাধে তাঁর কলিজার টুকরো সন্তানদেরকে পিতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত করলেন, কী অপরাধ ছিল তাঁর? যার কারণে উনার গর্ভধারিণী বৃদ্ধা মা তাঁর কলিজার টুকরো সন্তানের ঘরে ফেরার অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে তিনি আজ মৃত্যু পথযাত্রী।
মরার আগে কলিজার টুকরো সন্তানের প্রিয় মুখখানি দেখতে পারবেন কিনা সন্দেহ। কী অপরাধ ছিল সিলেটের উন্নয়নকামী মানুষগুলোর? যাদেরকে বঞ্চিত করলেন এম ইলিয়াস আলীর যাদুকরী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে।
যিনি সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমানের মৃত্যুর পর সিলেট বিভাগে বিএনপির একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আভির্ভুত হন।
ইলিয়াস আলীর অপরাধ ছিল জুলুমবাজ, আর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বজ্রকন্ঠে প্রতিবাদ করার। তার অপরাধ ছিল আগ্রাসনবাদ আর সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলার। ভারতের উজানে টিপাইমুখ নামক স্থানে অভিন্ন নদীতে ভারতের অবৈধ বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদ একমাত্র প্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলীই প্রথম করেছিলেন। আমরা সীমান্তবাসীর ব্যানারে সিলেটে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন সমগ্র সিলেটবাসীকে নিয়ে। তার ডাকে লংমার্চ আর হরতালে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে সোচ্চার কন্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছিল সিলেটের লাখ লাখ মানুষ। ঠিক তখনই থমকে দাঁড়িয়েছিলো ভারতের অবৈধ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প, যার ধরুন সাম্রাজ্যবাদ আর আগ্রাসনবাদীদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। তাই রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে রাতের আধারেই দেশী – বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা গুম করে দেয় ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ ও বিশ্বনাথের যাদুকরী উন্নয়নের রুপকার প্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলীকে সাথে সাথে গুম করে দেওয়া হলো এ অঞ্চলের উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকেও। প্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলীর যাদুকরী উন্নয়নের সুফল আজও ভোগ করছেন ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ ও বিশ্বনাথের মানুষ।
৩২ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী প্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলী ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের রাজনীতিতে যোগ দেন। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে প্রিয় নেতা ১৯৯২ সালে ছাত্রদলের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ) আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন।
ভাবা যায়, ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ওসমানীনগর – বালাগঞ্জ ও বিশ্বনাথ নিয়ে গঠিত সিলেট ২ আসনের অবহেলিত এ অঞ্চলে এরকম অভাবনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হবে। প্রায় লক্ষাধিক ভোটে এ অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি হয়েই প্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলী আমূল পরিবর্তন আনেন এ অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থাসহ সকল অবকাঠামোগত উন্নয়নে। যে অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ বর্ষায় নৌকা আর হেমন্তে পায়ে হেটে কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে চলাচল করতো সেই ওসমানীনগর – বালাগঞ্জ ও বিশ্বনাথের রাস্তাঘাট – ব্রিজ, কালভার্ট -স্কুল – কলেজ এবং বিদ্যুতয়ানের দৃশ্যপট রাতারাতি পাল্টে দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষকে সহজলভ্য ভাবে চলাচল করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। মনে পড়ে ২০০৪ সালে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় এ অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ যখন পানিবন্ধি হয়ে পড়েছিল। তখন তিনি একদিনের জন্যও বিচ্ছিন্ন হননি পানিবন্ধি মানুষের কাছ থেকে। সরকারি অনুদানসহ তার এবং প্রবাসী বিএনপির নেতাকর্মীদের পাঠানো অনুদান দিয়ে পানিবন্ধী মানুষের দুঃখ -দূর্দশা লাগব করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বন্যার পানি চলে যাওয়ার পর পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাটগুলো পুনরায় মেরামত করে দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ যাতে আর দুর্ভোগ পোহাতে না হয় সেদিকে যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন তিনি।
আমার ক্ষুদ্র এ রাজনৈতিক জীবনে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে প্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলীকে। আমি তাঁকে যতটুকু দেখেছি, খুব রাগী হলেও একইসঙ্গে দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ আর কর্মীঅন্তঃপ্রাণ মানুষ ছিলেন ইলিয়াস আলী।
তাই তো রাজধানী ঢাকার মহাখালী থেকে যেদিন কাপুরুষরা রাতের আধারে বৃহত্তর সিলেটের সিংহ পুরুষ, সিলেটবাসীর প্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলীকে গুম নামক কারাগারে বন্দী করার দুঃসংবাদ যখন গভীর রাতে এ অঞ্চলের জনতার কানে পৌঁছালো তখন ভোর থেকেই সকল শ্রেণী পেশার মানুষ আবাল- বৃদ্ধ থেকে শুরু করে জাতী- ধর্ম – বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ক্ষোভে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে সিলেটের রাজপথ, অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে সমগ্র দেশও। প্রিয় নেতাকে ফিরে পাবার আন্দোলন করতে গিয়ে তার জন্মভূমি বিশ্বনাথের তিনজন নিহত হয়েছেন। হাজার হাজার নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। জেলের গ্লানি টানতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন। এত সব কিছুর পরও প্রিয় নেতাকে ফিরে পাবার আকুতি ছিল। এ আকুতি শুধু দলীয় নেতাকর্মীদের মনে নয়, সমগ্র সিলেটবাসীর। সিলেটের মানুষ যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো, যাকে কেন্দ্র করে সিলেটের আগামীর উন্নয়ন সাধিত হতো সেই নেতাকে এভাবে নিখোঁজ করা হবে অলীক কল্পনাও হয়তো করেনি সিলেটের মানুষ। বাস্তবিক অর্থে তাই ঘটলো যা আজ অব্দি কোন খোজঁ মিললো না।
সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্র চাইলেই খুঁজে বের করে দিতে পারতো তাঁকে, তার জন্যই তো প্রিয় নেতার নিখোঁজের পরদিন উনার স্ত্রী সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা দেখা করেন প্রধানমন্ত্রীর সাথে। প্রধানমন্ত্রী আশ্বাসও দিয়েছিলেন রাজনীতির উর্ধ্বে মানবতা, তাই মানবতার খাতিরে হলেও ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করে দিবেন। যাই হোক প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আশ্বস্ত হলো পরিবারসহ সমগ্র দেশবাসী। কিন্তুু বিধিবাম রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির মানবতায় যে আজও টনক নড়লো না। শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যই সিলেটের রত্নগর্ভা সন্তানকে তার গাড়ী চালক আনছার আলীসহ তুলে নিয়ে গুম করে দেওয়া হলো।
এই পবিত্র রমজান মাসে মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিনের দরবারে ফরিয়াদ জানাই আল্লাহ পাক যেন আমাদের প্রিয় নেতাকে জুলুমকারীদের গুম নামক কারাগার থেকে আমাদের মাঝে সুস্থ এবং অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেন। আমিন।
লেখক : সাবেক যুগ্ম আহবায়ক, ওসমানীনগর উপজেলা ছাত্রদল।