আর্জেন্টিনার জয়-পরাজয়: বাংলাদেশের শঙ্কা ও সতর্কতা

বিলাল হোসেন ::
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:০১:৩৭,অপরাহ্ন ১৭ ডিসেম্বর ২০২২সন্দেহ নেই, ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি ফুটবলপ্রিয় জাতি। ক্রিকেটের প্রতিও আমাদের রয়েছে আলাদা আবেগ ও ভালোবাসা। এখন বিশ্বের আনাচে কানাচে দেখা মেলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অসংখ্য ভক্ত অনুরাগীর। হাল আমলে আমাদের সোনার মেয়েরা সাফ চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা অর্জন করে বাংলাদেশ ফুটবলে বিস্ময়কর আবেদন যোগ করেছে। যদিও আমাদের ফুটবল এখনো বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রতিযোগিতা করার উপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি। তাই বলে বাঙালি বিশ্বকাপ উপভোগ করবে না? তা সম্ভব? বাঙালি সবসময়ই উপভোগ প্রিয়। উৎসব প্রিয়। আনন্দ প্রিয়। তারা দুর্ভিক্ষের সময়ও ধরতে পারে প্রেমের গান, উৎসবের গান…
১৮ ডিসেম্বর (রোববার) বিশ্বকাপ ফাইনাল। বিশ্বফুটবলের দুই পরাশক্তি ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনা বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় মুখোমুখি হবে কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে। এমবাপ্পে-গ্রিজম্যানরা কোনো অবস্থাতেই তাদের তৃতীয় ও টানা দ্বিতীয় শিরোপা হাতছাড়া করতে চাইবে না। অন্যদিকে ৩৬ বছরের দীর্ঘ বিরহ থেকে আর্জেন্টিনার মুক্তি ও লিওনেল মেসির শেষ বিশ্বকাপ রাঙাতে তারাও একবিন্দু ছাড় দিবে না তৃতীয় বিশ্বকাপ ঘরে তুলতে। ম্যাচ শুরু হলে আনন্দ উল্লাসের ভেতরেও আমাদের মনে একধরনের উদ্বেগ ও আশঙ্কা উঁকি দেওয়া শুরু করে!
খুব করে চাই এই আশঙ্কা যেনো শতভাগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। আর্জেন্টিনা যদি ফাইনালে হেরে যায়, তাদের মাথা নষ্ট পাগলা ভক্তদের মুখগুলো কল্পনা করলে আমি আৎকে উঠি! আমার ভয় লাগে। আমাদের চরম আবেগি বাংলাদেশি ভক্তদের কথা চিন্তা করে ভেতর ঘেমে ওঠে! ফ্রান্স যদি হেরে যায় এই সংশয়ের ১ভাগও অবশিষ্ট থাকে না। এদেশের কোন সরল মায়ের মুখের হাসি মুছে যাওয়ার সংশয় থাকে না। ফ্রান্সের হার নিয়ে এসব ভাবলে সামান্য প্রশান্তিও খেলে যায় মনে।
বিশ্বব্যাপী ব্রাজিল- আর্জেন্টিনার অজস্র পাগলা ভক্ত রয়েছে। অনেকে অন্য দল সমর্থন করলেও আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের খেলা দেখার জন্য প্রায় সকলেই মুখিয়ে থাকে। এ এক অন্যরকম ভালোলাগা। অন্যরকম আনন্দ অবলোকন।
তবে এই দুই দলের এ দেশিয় ভক্তরা একটু বেশিই উন্মাদ। একটু বেশিই খ্যাপাটে। ক্ষেত্রবিশেষে একটু বেশিই ঘাড়ত্যাড়া! এসব ভক্তরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খেলাটিকে বিনোদনীয় ভালোবাসা ও ভালোলাগার জায়গায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে পারে না। তারা সিরিয়াসলি এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ছোট করায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। রুচিহীন ট্রলে টক্কর চলে সমানতালে। বিশ্বকাপে খেলা আর্জেন্টিনা- ব্রাজিলসহ বিশ্বের মহান ফুটবলারদের নিয়ে লজ্জাজনক নোংরামিও চোখে কম পড়ে না। আর এসব বিষয় নিয়ে অনেক আপন সম্পর্কও রূঢ়তার পর্যায় থেকে চরম অবনতির আকার ধারণ করে। হাতাহাতি, মারামারি, আত্মহত্যা এমনকি হত্যাকাণ্ডেরও সংবাদ আমরা প্রতিটি বিশ্বকাপ শেষে পড়েছি/দেখেছি।
লড়াকু বাঙালিদের খেলাধুলাকে উপলক্ষ করে অন্য একটি দেশের সমর্থনের ক্ষেত্রে এমন আচরণ কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সুন্দরকে অসুন্দর করে তোলা, সামান্য, এমনকি অনেকাংশেই অপ্রয়োজনীয় মত-পার্থক্যকে সহিংসতায় রূপ দেওয়া- জাতি হিশেবে বিশ্বের কাছে আমাদের ছোট করে। মহান বিজয় দিবসের মাসে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে অপমানিত করে। একজন সময় সচেতন দেশপ্রেমিক, ক্রীড়া প্রেমিক বাঙালি হিশেবে নিজের জন্মভূমিকে আমরা লজ্জা দিতে পারি না। এটি উপলব্ধির জন্য আমাদের শুদ্ধ আত্মচর্চার বিকল্প নেই। নমনীয়তায় পারদর্শী না হলে সময়কে জয় করা সম্ভব নয়।
এবার আসি উপরে আঁকা আশঙ্কার ভীতিজাগানিয়া প্লাটফর্মে। আমাদের দেশের, বিশেষ করে ব্রাজিল- আর্জেন্টিনা ভক্তরা ফাইনালের আগে বাদ পড়ে গেলে যে সহনীয় আচরণ দেখায়, ফাইনালে হেরে গেলে নিজেকে আর সে পর্যায়ে ধরে রাখতে পারে না। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে নিজের বোধ-বুদ্ধির স্টিয়ারিংয়ের। আর মহূর্তেই ঘটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত, কুৎসিত, ভয়ংকর ও লজ্জাজনক অনেক কর্মকাণ্ড। এসব ক্ষেত্রে আমাদের অসচেতনতা, উদাসীনতা, নিজের প্রতি প্রতিদিনের বোঝাপড়া না থাকা, অন্যের পছন্দ অপছন্দের সম্মান করতে না জানা, ভিন্ন মতকে সহ্য করতে না পারার মতো বিষয়গুলোই প্রধান নিয়ামকের কাজ করে। এসব নিয়ে আমাদের ভাবনার সময় এসেছে। অন্তত একজন বাংলাদেশি হিশেবে ভাবতেই যে হবে!
ফ্রান্সের হেরে যাওয়া কামনা করছি কেনো? প্রথমত একজন আর্জেন্টিনার সাপোর্টার হিশেবে এটি আমি ডিমান্ড করতেই পারি! দ্বিতীয়ত লিওনেল মেসির মতো একজন গ্রেট ফুটবলারের হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি নিশ্চয় আপনিও দেখতে চাইবেন! তৃতীয়ত ও প্রধানতম এই অণুসঙ্গটিই ফ্রান্সের হার কামনা করার একদম সহজ ও সরল কারণ। এ দেশে ফ্রান্সের সমর্থক থাকলেও তারা অতি আবেগি বা বিশাল সংখ্যাগোষ্ঠী নয়। আর ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় নেওয়ায় তাদের সাপোর্টাররাও মনস্তাত্বিক স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়েছে। অনেকে আবার আর্জেন্টিনাও সাপোর্ট করছে। কেউ কেউ বৈধ ট্রলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গরম করছেন। আবার দুই পক্ষের কারো কারো বেপরোয়া, অশালীন ও চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ লক্ষণীয় মাত্রায় ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যা মোটেও কাম্য নয়।
এদিকে আর্জেন্টিনা ভক্তরা রয়েছে ফুল রিদমে। তাদের মন মানসিকতা এখন আনন্দ, উচ্ছ্বাস ও আবেগের তুঙ্গে। আর এখানেই আমাদের সকল ভয়, সকল অস্থিরতার বদ-ভাবনা। যদি আর্জেন্টিনা ফাইনাল মঞ্চে হেরে যায়? যদি মেসি, দি মারিয়াদের কান্নাভেজা চোখ ভেসে ওঠে টিভির পর্দায়! তখন না জানি কতো অতিমাত্রার আবেগপ্রবণ সমর্থকেরা কতো হৃদয়বিদারক ও দুঃখজনক ঘটনার না জন্ম দেয়! কারণ, এমন দুঃসংবাদ প্রতি বিশ্বকাপ ফুটবলেই আমাদের অনেক চোখের জল ঝরিয়েছে। স্তব্ধ করে দিয়েছে কতো কতো পরিবারের রঙিন স্বপ্ন। আলাদা করে দিয়েছে কতো পবিত্র সম্পর্ক। ভাবতে পারেন, কী মর্মান্তিক!
অবশ্য এগুলোর প্রকৃত কারণ আমাদের মানসিক দৈন্যতা। নিজেদের বদগুণ এই একরৈখিকতা মেনে নিয়েই কঠোর সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে সামাজের প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ, পরিবারের প্রধান, দায়িত্বশীল বন্ধু, বিশ্বস্ত কলিগগণ ও আনন্দপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী সবাই সবার প্রতি আন্তরিক, শ্রদ্ধাশীল ও খেয়ালমনা হয়ে গেলে অনেক অঘটন রোধ করা সম্ভব বলে আমি করি। আপনি কী মনে করেন?
জগতের সকল প্রাণীর মঙ্গল হোক
আত্ম-চর্চায় উদ্ভাসিত হোক আমাদের আত্মা…
লেখক: কবি।