প্রিন্সিপাল হাবিবের অভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সিলেটবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:২৮:২২,অপরাহ্ন ২০ অক্টোবর ২০১৯আধ্যাত্মিক নগরী সিলেটের ‘সিংহপুরুষ’ খ্যাত প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমানের অভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সিলেটবাসী। তার শেষ দিনগুলো কেটেছে অনেকটা ঘরবন্দি হয়ে। মৃত্যুর বছর তিনেক আগে প্যারালাইজডে আক্রান্ত হন তিনি। এরপর থেকেই নানা আন্দোলনে ‘মাঠ কাঁপানো’ এই নেতার চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে। কমে যায় মঞ্চে-সমাবেশে উপস্থিতি। ডাবায়েটিজ ও হাইপ্রেসারে থাকা এই নেতা অসুস্থতার একটা সময় ভোগেন আংশিক স্মৃতিবিভ্রমে। চিকিৎসা হয়ে উঠেছিল নিত্য সঙ্গী। অন্তিমে এসে কিছুটা সুস্থ্য হয়ে উঠছেন যখন— ফিরছিল স্বাভাবিক স্মৃতি, আগের ত্যাজ ও ছন্দ উদ্দীপ্ত হচ্ছিল কণ্ঠে, তখনই বিদায়ের ডাক এলো তাঁর। ১৯ অক্টোবর ২০১৮। শুক্রবার রাত। নিভে গেল দীপ্ত আলো। অস্তমিত হল কালের সাক্ষী। গতকাল ছিল তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
বিভাগীয় শহর থেকে দীপ্তি ছড়ানো প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমানের ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে ছিল সীমানা থেকে সীমানায়। স্থানীয় অঙ্গন ছাপিয়ে তাঁর কণ্ঠস্বর পৌঁছে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। সিলেটের কোর্টপয়েন্টে দেওয়া তার গর্জন কাঁপন ধরিয়েছে ঢাকার মসনদে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ ইসলামি ব্যক্তিত্ব, মুসলিম নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তৈরি হয়ে ছিলো তাঁর নিবিড় যোগাযোগ। উম্মাহর সঙ্গে যোগসূত্রের সেতুবন্ধন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁর নিমন্ত্রণেই বিশ্বখ্যাত ইসলামি ব্যক্তিত্বরা এসেছিলেন বাংলাদেশে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কাজির বাজার জামেয়ার বার্ষিক সম্মেলনের ঐশ্বর্য ছিলেন এসব বিদেশি আলেম-উলামা।
এই তালিকায় রয়েছেন পাকিস্তানের হাফিজুল হাদিস আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী (রাহ.), ভারতের আল্লামা সাইয়্যিদ আসআদ মাদানি (রাহ.), মসজিদে আকসার ইমাম শায়খ আলী উমার ইয়াকুব আল আব্বাসি, আরব আমিরাতের বিচারপতি শায়খ সায়েফ আলী আল মুসলিম, সৌদির প্রখ্যাত আলিম শায়খ ওয়াহেব আল খাউজ, ফিলিস্তিনের ড. শায়খ তামিম আল আদনান, ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠাতা হাসানুল বান্নার সহযোগী মিশরের শায়খ আব্দুল মুইদ আব্দুস সাত্তার, পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা জারওয়ালী খান, আল্লামা ফেদাউর রহমান দরখাস্তি, মুফতি রাফি উসমানি, বিচারপতি মুফতি তাকি উসমানি, জিয়াউর রহমান ফারুকী। এসেছিলেন, ড. কলিম সিদ্দিকী, ভারতের ড. সিদ্দিকুল্লাহ, মাওলানা সাইয়্যিদ মাহমুদ মাদানি, ভারতের বর্তমান সংসদ সদস্য মাওলানা বদরুদ্দীন আজমল প্রমূখ। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এমন বিশ্ববরেণ্যদের আলোয় উদ্ভাসিত জামেয়া মাদানিয়া। এই তালিকার অনেকে প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমানের নিমন্ত্রণেই বাংলাদেশ সফর করেছেন।
প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান কর্মজীবন শুরু করেছিলেন একটি মসজিদে। ১৯৭৩ সালে। ইমাম হিসেবে। খুব বড় মসজিদ ছিল না, খ্যাতিও ছিল না। এখন থেকে ৪৫ বছর আগে সিলেট তখন পৌরসভা। ছোট, ছিমছাম, কোলাহলমুক্ত শহর। সেই শহরের কাজিরবাজার এলাকায় মসজিদটি। লোকমুখে পেঁয়াজাহাটা মসজিদ নামে পরিচিত। সেই মসজিদের মিম্বর থেকেই রাজনীতির মঞ্চে পদার্পন প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমানের।
পেঁয়াজহাটা মসজিদটির অবস্থান (এখনো) সিলেট বিধৌত সুরমা নদীর তীরে। এই মসজিদ থেকেই শুরু হয় জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার মাদরাসার। ১৯৭৪ সালের ৫ জুনে। আলিয়া মাদরাসায় কামিল পড়ে এসে আল্লামা হাবিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন পুরোদস্তুর কওমি মাদরাসা। সূচনাতেই স্বপ্ন-পরিকল্পনায় পরিবর্তনের আভাস ছিল জামেয়ার। কওমি মাদরাসার প্রধানরা যখন মুহতামিম ছাড়া ভিন্ন উপধি গ্রহণ ভাবনার সীমানায় জায়গা দিতে অপ্রস্তুত, তখন হাবিববুর রহমান তাঁর মুহাতামিম পদবিকে প্রিন্সিপালে পরিবর্তন করে বড় একটা ঝাঁকুনি দেন। এই পদবি নিয়ে শুরুতে অনেকের উন্নাসিকতা ছিল। অস্বস্তি ছিল। কিন্তু প্রিন্সিপাল অটল থাকেন। এই প্রিন্সিপাল বিশেষণই পরে তাঁকে অন্য সবার চে’ ভিন্ন ও অনন্য করে। কওমি মাদরাসায় প্রিন্সিপাল বলতেই মূর্ত হয়ে উঠে হাবিবুর রহমানের অবয়ব।
কাজিরবাজার মাদরাসার সূচনা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায়। দেশের কওমি মাদরাসায় তখনও পাকিস্তান আমলের শিক্ষাধারার প্রবল প্রতাপ। জাগতিক বিষয়ের শিক্ষা তখনো অচ্ছুত। এমন সময়েই নব প্রতিষ্ঠিত কাজির বাজার মাদরাসার সূচনাতেই সিলেবাসে মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে গুরুত্ব পায় বাংলা, ইংরেজিসহ জাগতিক শিক্ষা। যুক্ত হয় কারিগরি শিক্ষাও।
১৯৯৯ সালেই মাদরাসার ছাত্রদের কম্পিউটার শিক্ষার সূচনা হয়। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মুসলিম জনসাধারণদের লাশ গোসল ও কাফন-দাফনের সেবা শুরু হয় ২০০০ সালে। যুক্ত হয় অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এই সেবা সূচনায় পথিকৃত কাজির বাজার জামেয়া। মাত্র পাঁচ ছাত্র দিয়ে শুরু করা এই প্রতিষ্ঠান খুব কম সময়েই কওমির সর্বোচ্চস্তর দাওরায়ে হাদিসের ক্লাশ শুরু করে। এখন চালু রয়েছে ইফতা বিভাগও। সিলেটে ইফতা শুরুর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান কাজির বাজার মাদরাসা। বেফাক বোর্ডের অধীন পরিচালিত এই মাদরাসা একাধিকবার বোর্ডসেরার সম্মান অর্জন করে খ্যাতি কুড়িয়েছে।
সত্তুরের দশকে প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান যখন বিকশিত হচ্ছিলেন, তখন তাঁকে আলো দিচ্ছেলন, অভিভাবক হিসেবে ছায়া দিচ্ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের আমৃত্যু সভাপতি আল্লামা আব্দুল করিম শায়খে কৌউড়িয়া (রাহ.), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রাহ), আল্লামা আব্দুল্লাহ হরিপুরী (রাহ.), আল্লামা নুর উদ্দিন গহপুরী (রাহ.) প্রমূখ। এই বুজুর্গদের প্রত্যেকে প্রিন্সিপাল হাবিবের বিকাশে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন। সময়ে-দুঃসময়ে তাঁকে গাইড করেছেন। অভিভাবক হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছেন। এইসব দিকপালের নির্দেশনা ও স্নেহছায়ায় থেকে খ্যাতির শীর্ষে উঠেন প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান।
সিলেটে নানা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান। বিতর্কিত ও ইসলামবিদ্বেষী লেখিকা তসলিমা নাসরিনবিরোধী আন্দোলন সারা দেশে দুর্বার হয়েছিল, ১৯৯৪ সালে তসলিমাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য মূলত মাঠে প্রিন্সিপালের তেজ্যেদীপ্ত ও সাহসী অবস্থানের কারণে। তসলিমা এই জ্বালা ভুলেননি। প্রিন্সিপালের ইন্তেকালের খবরে ভেতরের বিষজ্বালা ঝেরেছেন ফেসবুকে।
এছাড়াও ১৯৮১ সালে সিলেট এমসি কলেজের অধ্যাপক সর্দার আলাউদ্দিন কর্তৃক পবিত্র কোরআন অবমাননা, ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙা, ১৯৯২ সালে জামায়াতে ইসলাম কর্তৃক সাহাবাদের অবমাননাসহ ইসলামবিরোধী যেকোনো ইস্যুতে প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান প্রতিবাদের এক আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। মানুষও এসব আন্দোলনের কারণে তাঁকে প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছে। সেই ভালোবাসার স্বাক্ষর হলো তাঁর নামাজে জানাযা। ১৯ অক্টোবর শুক্রবার সিলেট আলীয়া মাঠে তাঁর নামাজে জানাযায় যে পরিমাণের লোক সমাগম হয়েছে। এমনটা বৃহৎ দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রধানদের জনসভায় কখনো হয়নি। সিলেটে কোনো জানাযাকে ঘিরে মানুষের এমন আবেগ আর শ্রদ্ধাও নজরে পড়েনি। জনসমাগমের দিক থেকে সিলেটে সবকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে প্রিন্সিপালের জানাযা। এই রেকর্ড ভাঙার নয়।