বুরুঙ্গা: শত শহীদের এক গর্বিত জনপদ

সারওয়ার চৌধুরী
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৫৬:০৬,অপরাহ্ন ১৬ ডিসেম্বর ২০২১আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেকেই ইনিয়ে-বিনিয়ে গল্প লেখেন, কবিতা লেখেন। আমার প্রশ্ন হলো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেন এভাবে লিখতে হবে? কেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রায় সবগুলো গল্প-কবিতার রূপ কাছাকাছি? মুক্তিযুদ্ধের সব ভিকটিম কি একই ধরনের? মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে লিখতে হলে প্রকৃত ঘটনা লিখুন, সত্যাশ্রয়ী হোন। ঘুরে আসুন মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকায়, তথ্য সংগ্রহ করুন জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে, যুদ্ধকালীন সময়ের বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির কাছ থেকে। এগুলো কোনো দুঃসাধ্য কাজ নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকাতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য ঘটনা, তার স্মৃতি ও সাক্ষী রয়েছেন। আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের গল্প, কবিতাকে মিছে কল্পনার সম্ভার দিয়ে সাজাই, তবে শতসহস্র প্রকৃত ঘটনা কিন্তু আমাদের কিংবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অজানাই রয়ে যাবে।
আমার নিজের গ্রাম হচ্ছে বুরুঙ্গা। সিলেট জেলার ওসমানীনগরে অবস্থিত। বুরুঙ্গা এমন এক নাম, এমন এক গ্রাম, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে রয়েছে যার এক বিশাল বিরহগাঁথা। বুরুঙ্গায় একই দিনে প্রায় এক শ লোক শহীদ হয়েছিলেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একই দিনে একসঙ্গে একই স্থানে জড়ো করে গুলি চালিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল নিরীহ নিষ্পাপ তাজা প্রাণগুলো।
২৫ মে, ১৯৭১ সাল। দুপুরবেলা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আসার খবরে বুরুঙ্গা ও তার আশপাশের গ্রামের লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিকেল ৪টায় তারা স্থানীয় চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে। সাক্ষাৎ শেষে বুরুঙ্গা ও তার আশপাশের গ্রামে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হয় যে, পরদিন ২৬ মে বুরুঙ্গা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে একটি শান্তি কমিটি গঠন করা হবে এবং ‘পিস কার্ড’ বিতরণ করা হবে।
ভয় স্বত্বেও বুরুঙ্গা ও তার আশপাশের গ্রামের লোকজন বুরুঙ্গা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এসে সকাল ৮টা থেকে জমা হতে থাকে। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক হাজারেরও অধিক মানুষ এসে সমবেত হয়। সকাল ৯টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ দেশীয় দোসরদের তত্ত্বাবধানে জিপে করে বিদ্যালয় মাঠে এসে পৌঁছায়। অন্য একটি দল গ্রামের ঘরে ঘরে যায় এবং পুরুষদের বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত হতে আদেশ দেয়। সকাল ১০টায় সমবেত জনতাকে পৃথক দু ভাগে বিভক্ত করে হিন্দুদের অফিস কক্ষে একত্রিত করা হয় এবং মুসলিমদের বিদ্যালয়ের অন্য একটি শ্রেণিকক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। উপস্থিত হিন্দুদের রশি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। এতে তাদের মধ্যে কয়েকজন ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করে। এরই মধ্যে একজন বন্দী শ্রীনিবাস চক্রবর্তী একটি জানালা খুলতে সমর্থ হন। প্রীতি রঞ্জন চৌধুরী (বুরুঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক) ও রানু মালাকার জানালা দিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের ওপর গুলি চালায়। কিন্তু তাঁরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
দুপুরের দিকে বিদ্যালয় ভবন থেকে হিন্দুদের বাইরে মাঠে নিয়ে আসা হয় এবং তাদের নব্বইজনকে তিনটি সারিতে দাঁড় করানো হয়। ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিনের নির্দেশে তিনটি লাইট মেশিনগান থেকে তাদের ব্রাশফায়ার করা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তখন মৃতদেহগুলোর ওপর কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বেলে দেয়।
আরেকটি ঘটনা। রামরঞ্জন ভট্টাচার্য, সিলেট জজ কোর্টের তৎকালীন নামকরা ও প্রভাবশালী উকিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে আটক হন। জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে যেতে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই পেছন থেকে গুলি করা হয়। তিনি তৎক্ষণাৎ মারা যান। ফিরে আসি আগের ঘটনায়। হত্যাকাণ্ডের পর দশ-বারোজন দোসরের একটি দল গ্রামে লুটপাট চালায় এবং নারীদের উত্ত্যক্ত করে। পরদিন পাকিস্তানি হানাদাররা আবার বুরুঙ্গায় আসে। চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় তারা কিছু শ্রমিক ভাড়া নেয় এবং বুরুঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে একটি গর্তে দগ্ধ ও অর্ধদগ্ধ মৃতদেহগুলো কবর দেওয়া হয়। শ্রীনিবাস চক্রবর্তী, জিতেন্দ্র বাইদ্যা ও অধীর মালাকারসহ খুব কম লোকই গুরুতর আহত হওয়ার পরও বেঁচে যান। মৃতের সঠিক সংখ্যা গণনা করা যায়নি। যদিও ৭১ থেকে ৯৪ জনের হিসাব পাওয়া যায়। যা-হোক, এটা সর্বসাধারণের দ্বারা স্বীকৃত যে এই হত্যাকাণ্ডে ৭৮ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছিল।