মতপ্রকাশ করা কোনো অপরাধ নয়: ঝুমন

সুরমা নিউজ ২৪ ডট নেট
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:০৬:২১,অপরাহ্ন ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। নিজের মত নির্ভয়ে প্রকাশ করা কোনো অপরাধ নয়।- বললেন ঝুমন দাস।
সুনামগঞ্জের হাওরবেষ্ঠিত শাল্লার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা ঝুমন। যে গ্রামে যাওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো সড়ক নেই। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াও তার সামান্যই। পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে প্রায় সাড়ে ছয় মাস জেল খেটেছেন।
তবু সাড়ে ছয় মাস পর জেল থেকে বেরিয়ে এই গ্রামীণ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পাওয়া এই যুবকের দৃঢ় উচ্চারণ- ‘মত প্রকাশ করা কোনো অপরাধ নয়’। দীর্ঘ কারাবাসও এই বিশ্বাস থেকে টলাতে পারেনি তাকে।
হেফাজতে ইসলামের সাবেক নেতা মাওলানা মামুনুল হককে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে গত ১৬ মার্চ আটক হন ঝুমন দাস। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে পুলিশ। এই মামলায় প্রায় সাড়ে ছয় মাস জেল খেটে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান ঝুমন।
বুধবার দুপুরে ঝুমন দাসের সাথে আলাপ হয়। ঝুমন দাস বলেছেন, তার সাথে ঘটে যাওয়া, জেলজীবন আর নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা নিয়ে।
সাড়ে ছয় মাস জেল খাটলেও নিজের অপরাধটা কি তা এখনও জানেন না ঝুমন।
বলেন, কি কারনে আমাকে এতোদিন জেলে রাখা হলো তা জানি না। আমার অপরাধ কি? আমি আমার মত প্রকাশ করেছি। কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে লিখি। জীবনে কোনোদিনই কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে বলি নি। আমরা এখানে সব ধর্মের মানুষজন মিলেমিশে চলি।
ঝুমন বলে চলেন, তবে আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আমাদের পুরো পরিবার স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি। আমাদের পরিবারে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন। আমি কোনো দল করি না। তবে স্বাধীনতায় সপক্ষে বিশ্বাসী।
‘একারণেই আমি মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়ও বিশ্বাসী। আর কেউ স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের বিরদ্ধে বললে খারাপ লাগে। এই খারাপ লাগা থেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। এই অধিকার আমার আছে। আমি কোনো ধর্ম নিয়ে তো বলিনি। একজন ব্যক্তির সমালোচনা মানে কোনো ধর্ম বা গোষ্টির সমালোচনা নয়।’
মামুনুল হকের সমালোচনার কারণে ১৬ মার্চ রাতে আটক করা হয়েছিলো ঝুমনকে। পরদিন ১৭ মার্চ সকালে কয়েকজ হাজার সশস্ত্র লোক মিছিল নিয়ে হামলা চালায় ঝুমনদের গ্রাম নোয়াগাওয়ে। ভাঙচুর করা হয় ঝুমনের ঘরসহ গ্রামের অন্তত ৯০টি হিন্দু ঘর।
সকালের এই তান্ডবের ঘটনা ওইদিন সন্ধ্যায় জানতে পারেন ঝুমন।
তিনি বলেন, ‘‘১৬ মার্চ শাল্লা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমাকে সুনামগঞ্জ শহরের একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। ১৭ মার্চ সন্ধ্যার শাল্লা থানার দুজন পুলিশ সেখান থেকে আমাকে সুনামগঞ্জ আদালতে নিয়ে যান। তারাই বলেন- ’তোমার গ্রামে তো হামলা হইছে। তোমাদের বাড়িও ভাঙা হইছে।’ এই খবর শুনে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। পরিবারের সদস্যদের জন্য খুব চিন্তা হাচ্ছিলো। তবে তখনও পুরোটা আঁচ করতে পারিনি ঘটনার ভয়াবহতা। পরে সমস্ত ঘটনা জানতে পারি।
হাওরের গ্রামের মুক্ত যুবকের জেলখানার বন্দিজীবন কেমন কেটেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খারাপ তো লাগতোই প্রথম প্রথম প্রথম বেশি খারাপ লাগতো।
জেলে আমার সময় কাটতো বই পড়ে। সুনামগঞ্জ কারাগারে লাইব্রেরিতে বঙ্গবন্ধু কর্ণার রয়েছে। সেখানে গিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বই পড়া যায়। কিছুদিন পর নির্ধারিত বই নিজ সেলেও নিয়ে আসাও যায়। আমি কারাগারে থাকাকালীন সময়ে প্রচুর বই পড়েছি। কারাগারের কর্মীরাও আমাকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন,- বলেন ঝুমন।
সুনামগঞ্জে ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন ঝুমন। করোনা আর কারাগার এই দুইয়ের কারণে তা শেষ হয়ে গেছে। জেল থেকে বের হওয়ার পর এখন জীবিকার সংস্থানই তার মূল চিন্তা। ঘরে মা, স্ত্রী আর ছোট্ট সন্তান রয়েছে।
ঝুমন বলেন, এখন কি করবো, কিভাবে আবার সংসার চালবো তা বুঝে উঠতে পারছি না। তারউপর আদালত নির্দেশ দিয়েছেন- অনুমতি ছাড়া সুনামগঞ্জের বাইরে বের হওয়া যাবে না। আমি আদালতের উপর আস্থাশীল। তাদের নির্দেশনা মেনে চলবো। এসব মেনেই কিছু একটা শুরু করতে হবে।
মাত্র বের হলাম। এখনো এনিয়ে কিছু চিন্তা করিনি। কয়েকদিন যাক। তারপর চিন্তা করবো। কিছু তো করতেই হবে।- বললেন ঝমুন দাস।
দীর্ঘদিন জেলে থাকার ফলে শারিরীক ও মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলেও জানান তিনি।
ঝুমনের ছেলের নাম ঈশান। বয়স আট মাস। দুই বয়সী শিশুকে রেখেই জেলে যেতে হয় ঝুমনকে।
দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফেরা বাবার কোলে আসে না ঈশান। বাবাকে কি চিনতে পারে না সে, নাকি দীর্ঘদিন দূরে থাকায় অভিমানে ছেলে কাছে আসে না- তা বুঝতে পারেন না ঝুমন। তার কষ্ট হয়।
বলেন, জেলে থাকাকালীন সময়ে ছেলের জন্য খুব খারাপ লাগতো। জেলে থাকাকালীন সময়ে ছেলের জন্য খুব খারাপ লাগতো। সবসময় মায়ের কথা মনে পড়তো। স্ত্রী, ভাইবোনদের কথাও মনে হতো। ছেলেকে কোলে নিতে ইচ্ছে করতো খুব । অথচ এতোদিন পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি আসলাম কিন্তু ছেলে কোলো আসছে না। একারণে খুব অশান্তি হচ্ছিলো।
তবে আজ সকাল থেকেই অভিমান ভেঙেছে ইশানের। সকাল থেকেই বাবার কোলে আসছে সে। ঝুমনের কোলে এখন ঈশান হাসে।
ঝুমন দাসের ভাই নুপুর দাস জানান, উচ্চ আদালত থেকে ঝুমনের জামিন আদেশের পর থেকেই তাদের গ্রামের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ নিয়মিত টহল দিচ্ছে।
দীর্ঘদিন পর ঝুমন বাড়ি ফেরায় স্বস্থির কথা জানিয়েছেন তার মা নিভা রানী দাস ও স্ত্রী সুইটি রানী দাস।
জামিন পাওয়ার পরই ঝুমনের নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। তবে এ নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, ঝুমন দাসের জামিন আদেশ পাওয়ার পরপরই তার নিরাপত্তার বিষয়ে এলাকায় খোঁজ খবর নেওয়া হয়েছে। কোন ধরনের নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ নেই। কারামুক্তির পর তার ও তার মাকে অফিসে এনে তাদের সাথে কথা বলেছি। এরপর তাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আমরা তার খোঁজ-খবর রাখব। ঝুমন দাস সবার মতই স্বাভাবিক জীবন-যাপন করবেন। কোন ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, গত ১৫ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে ‘শানে রিসালাত সম্মেলন’ নামে একটি সমাবেশের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম। এতে হেফাজতের তৎকালীন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বক্তব্য দেন।
এই সমাবেশের পরদিন ১৬ মার্চ মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন শাল্লার নোয়াগাঁওয়ের ঝুমন দাস। স্ট্যাটাসে তিনি মামুনুলের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অভিযোগ আনেন।
মামুনুলের সমালোচনাকে ইসলামের সমালোচনা বলে এলাকায় প্রচার চালাতে থাকেন তার অনুসারীরা। এতে এলাকাজুড়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দারা ১৬ মার্চ রাতে ঝুমনকে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
পরদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সকালে কয়েক হাজার লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করে হামলা চালায় নোয়াগাঁও গ্রামে। তারা ভাঙচুর ও লুটপাট করে ঝুমন দাসের বাড়িসহ হাওরপাড়ের হিন্দু গ্রামটির প্রায় ৯০টি বাড়ি ও মন্দির। ঝুমনের স্ত্রী সুইটিকে পিটিয়ে আহত করা হয়।
এরপর ২২ মার্চ ঝুমনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে শাল্লা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল করিম।
নোয়াগওয়ে হামলার ঘটনায় শাল্লা থানার এসআই আব্দুল করিম, স্থানীয় হাবিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল ও ঝুমন দাসের মা নিভা রানী তিনটি মামলা করেন। তিন মামলায় প্রায় ৩ হাজার জনকে আসামি করা হয়। পুলিশ নানা সময়ে শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। পরে তারা সবাই জামিনে মুক্তি পান।
হামলার দায়ে অভিযুক্তরা জামিন পেলেও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া ঝুমন জামিন পাচ্ছিলেন না। এনিয়ে সারাদেশেই ক্ষোভ দেখা দেয়। ঝুমনের জামিন দাবিতে আন্দোলনেও নামে বিভিন্ন গোষ্ঠি।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর ঝুমন দাসকে শর্ত সাপেক্ষ এক বছরের জামিন দেন বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। জামিন আদেশে আদালত বলেছেন, জামিন চলাকালীন সময়ে আদালতের অনুমতি ছাড়া ঝুমন দাস সুনামগঞ্জের বাইরে যেতে পারবেন না।