মহান বিজয় দিবস : প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

মোঃ আল আমিন
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৫২:১৬,অপরাহ্ন ১৬ ডিসেম্বর ২০২১সর্বকালের সর্বযুগেই প্রত্যেক পরাধীন জাতিই অনুভব করতে পারে বহু ত্যাগ-তিতীক্ষা, লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা তথা বিজয় দিবসের কি মাহত্ব এবং নিঃসন্দেহে যে কোনো দেশের যে কোনো জাতির জন্য রক্ত ঝরিয়ে, যুলুম-নির্যাতন সহ্য করে, আত্নহুতি দানের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন একটি গৌরবময় ঘটনা। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ বাংলাদেশের শুধু বিজয় দিবস নয় বরং বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের মুহুর্ত।। এই দিনটি বাঙ্গালী জাতির আত্নপ্রকাশের দিন, পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার দিন, আনন্দ গৌরব আর অহংকারে মহিমান্বিত একটি দিন, গর্ব করার একটি দিন এবং একই সাথে বড় কষ্টের, বেদনার আর মহাত্যাগের একটি দিন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও জাতীয় ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবের দিন, রক্তস্তাত মহান বাঙ্গালী জাতির হাজার বছরের শৌর্য-বীর্য আর বীরত্বের একটি অবীস্মরণীয় একটি ক্ষন। বিশ্ব মানচিত্রে লাল সবুজের পতাকা নিয়ে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখন্ড আত্নপ্রকাশ করে গৌরবদীপ্ত এই দিনেই।
বাঙ্গালী জাতিসত্তা কয়েক হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে নেগ্রিটো, মঙ্গোলীয়, ককেশীয় প্রভৃতি বিভিন্ন বর্ণের সমন্বয়ে। বর্তমানে যে ভূ-খন্ডটিকে বাংলা বলা হয় সেখানে এক সময় পুন্ড্র, বঙ্গ, হরিকেল, রাঢ়, বরেন্দ্র প্রভৃতি উপজাতি বসতি স্থাপন করেছিল এবং পরবর্তীকালে ঐসব অঞ্চল তাদের নামে পরিচিতি পেয়েছিল। এই উপমহাদেশের প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ন ও মহাভারতে বঙ্গ, প্রন্ড্রবর্ধনের নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে রচিত বৌদ্ধচর্চা ও দোহা গানে বাংলা ভাষার আদি রুপের পরিচয় পাওয়া গেলেও তা পূর্ণতা লাভ করে সুলতানী আমল তথা সুলতান হুসেন শাহ, নসরত শাহের আমলে।
বাংলাদেশর স্বাধীনতার ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। তবে এ স্বাধীনতার ইতিহাস ঠিক কবে থেকে শূরু তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। বৌদ্ধধর্মলম্বী চর্চাপদের কবি ভুষুক যে দিন স্বদেশকে মুক্ত স্বাধীন দেখার প্রত্যয়ে পদাবলী রচনা করলেন, ‘আজি ভুসুক বাঙালি ভইলি’ (আজি ভুসুক বাঙালি হলো)- তার এই রচনা বাংলার জাগরন আর বাঙালি জাতিসত্তা নির্মান তথা প্রকারান্তরে স্বাধীনতার পথরেখা তৈরীতে নিঃসন্দেহে একটি মাইল ফলক। এর প্রায় ৩শ বছর বছর ব্রিটিশ শাষনামলে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে আমরা দেখতে পাই জামালপুর-শেরপুর অঞ্চলে বাঙালী মুসলমান কৃষক নেতা টিপু শাহ (টিপু পাগলা), উত্তরবঙ্গ তথা বরেন্দ্র অঞ্চলে মুসলমান ফকির ও হিন্দু সন্নাসী বিদ্রোহীদের, পশ্চিমবঙ্গের নারকেলবাড়িয়ার মীর নিসার আলী তিতুমীর আর মালদহের দুদু মিয়াকে। আর ত্রিশের দশকে স্বদেশী আন্দোলনের নায়ক মাস্টার সূর্যসেন, মহাবিপ্লবী ক্ষুদিরাম ও অসম সাহসী নারী প্রিতিলতা ওয়াদ্দেদারকে দেখতে পাই বিট্রিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করে জীবনদান করে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে। পরবর্তীতে বাংলার স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে কৃষক বিদ্রোহের অনন্য বীরগাথাও আমরা বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই।
কিন্তু এর বা্ইরে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি, বিপ্লবী রাজনীতি এবং সাহিত্যে ও সংস্কৃতির অবদান ও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাঙ্গালির জাতিসত্তা নির্মানে অসামান্য। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি, হোসেন শহীদ সোহরাওর্য়ার্দী, চিত্তরঞ্জন দাশ, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয় প্রমূখের অবদান অনস্বীকার্য। আর নিয়মতান্ত্রিক ও সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু, বাঙালী জাতির অবিসাংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইএম কামরুজ্জামান) প্রমূখের নাম প্রাঃস্মরনীয়। আর তাদের সংগ্রামী জীবন ও রাজনীতির সার-সংস্কৃতি এবং লোকজসংস্কৃতির অবদান ও খুবই গুরুস্তপূর্ণ। বিদ্রাহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, দ্রিজেন্দ্রলাল রায়, লালন ফকির, হাসন রাজা, শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীন, পটুয়া কামরুল হাসান, সত্যজিৎ রায় সহ কবি শিল্পী সাহিত্যিক আলোকচিত্রীর বাঙালীর জাতীয় সংস্কৃতি নির্মানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আর এই সংস্কৃতির ভিত্তির ওপর নির্মিত হয়েছে বাঙালীর স্বাধীন রাষ্ট্র।
অস্ত্রের মুখে যুলুম নির্যাতন করে যারা আমাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চেয়েছিল, আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে বিজয়ের এই দিনেঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ারর্দী উদে্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে) তারা তথা দখলদার পাক হানাদান বাহিনীর আত্নসমর্পনের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার রক্তিম-সূর্য উদিত হয়েছিল। বিশ্বেন মানচিত্রে আনুষ্টানিকভাবে অভু্্যদয় ঘটেছিল লাল-সবুজের স্বাধীন সার্বভৌম ছোট্র নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। আর স্বাধীনতার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত জাতিকে স্বব্ধ করতেই একা্ত্তরের ২৫শে মার্চ কালোরাতেঅপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা অনুযায়ীপাক দখলদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আল শামসরা মেতে উঠেছিল ইতিহাসের জঘন্রতম গণহত্যাকান্ডে। রাজধানী ঢাকা সহ সারা দেশেই নির্বিচারে হত্যার করা হয় নিরস্ত্র, নিরীহ অগনিত ছাত্র, যুবক, নারী পুরুষ এমনকি অবুঝ শিশুও নির্মম অত্যাচার ও হত্যার শিকার হয়। সেই অমানবিক হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে এ দেশের ভাগ্যকাশে নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা। তাদের হত্যাযজ্ঞ, যুলুম-নির্যাতন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলার বাহিনীর নির্মমতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ভয়াভহতাকে ও ম্লান করে দেয়।
অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস হলো যদিও নিখিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাঙালি মুসলমানদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।
এরপরও বাঙালি জাতি পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে তার বিকাশের কোনো সম্ভাবনা দেখতে পায়নি। শুরু থেকেই পাকিস্তানি শাসকরা গণতন্ত্রের মৌল চেতনাকে উপেক্ষা করে সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর সংখ্যালঘিষ্ঠ শাসন চাপিয়ে দেয়। বাঙালির যে কোন দাবিকে বলপূর্বক দমনের পথ বেছে নেয় পাকিস্তানি শাসকরা। বাঙালি জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য অপমানকর মন্তব্য করেছে বিভিন্ন সময়। পাকিস্তানি শাসকদের কাছে বাঙালি মুসলমান প্রকৃত মুসলমান ছিল না!! তাদের কাছে বাঙালি নিকৃষ্ট জাতি নিকৃষ্ট মুসলমান!!!
একাত্তরের তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় ব্যাপকভাবে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের এক ঘৃণ্য কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছিল । বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি নারীদের কখনো নিজ বাড়িতে কখনও ক্ষেতে কখনও সেনাক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও ধর্ষণ করেছে। অনেক সময় স্থানীয় দালাল রাজাকাররা নারীদের ‘’গনিমতের মাল’’ বলে ধরে নিয়ে তুলে দিয়েছে সেনাদের হাতে আর সেনারাও অসহায় বাঙালি নারীদের নিয়ে মেতে উঠেছে পৈশাচিক উল্লাসে। বাংলাদেশে বসবাসরত ব্রিটিশ মিশনারি উদ্ধৃতি দিয়ে যুদ্ধাপরাধ ও গণতন্ত্র ১৯৭১ গ্রন্থে বলা হয়েছে সেনারা 8 বছর বয়সী বালিকা থেকে শুরু করে তাদের দাদি-নানির বেশি অর্থাৎ ৭৫ বছরের বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করা থেকে রেহাই দেয়নি। পাকিস্তানি সেনারা কেবল স্পট ধর্ষনই করেনি, হাজার হাজার বাঙালি নারীকে ধরে সেনা ছাইউনীতে নিয়েও দিনের পর দিন ধর্ষন করা হয়েছে।
তবে গনহত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে সেদিন দাবিয়ে রাখতে পারেনি পাকহানাদার বাহিনী বরং এই হত্যাকাণ্ডে শক্তিতে পরিণত করে। নারী-পুরুষ তরুণরা যুব সমাজ নির্বিশেষে ঝাপিয়ে পড়েছিল দেশরক্ষার যুদ্ধে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অবশেষে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে বীর বাঙালীর সাহসী সন্তানেরা। এই নয়টি মাস বাঙালীরা ব্যস্ততার মধ্যে দিন পান করেন। সঠিক ভাবে প্রতিরোধ গড়তে এসময় বাংলাদেশের ভূখণ্ড ১১ টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়েছিল। যদিও ১০ নম্বর নামে পরিচিত একটি সেক্টর সক্রিয় ও সুপরিচিত হয়নি। জুলাই-আগস্ট মাসে তিনটি ব্রিগেড আকৃতির বাহিনী সৃষ্টি হয়েছিল যার নাম ছিল জেড ফোর্স এস ফোর্স এবং কে ফোর্স।
হাজার ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে দেখা দেয় স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। রাজধানী ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন জোনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করে ৯৩ হাজার হানাদার পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সদস্য ও অতিরিক্ত কয়েক হাজার সহযোগী সদস্য এবং সেদিনই সূচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বিজয়। সেদিন বিকেল ৪.৩১ মিনিটে এ স্বাধীনতাপূর্ব বাংলার অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের পক্ষে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের উপস্থিতিতে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেন পাকিস্তানের পক্ষে জেনারেল নিয়াজী এবং মিত্রবাহিনীর পক্ষে জগজিৎ সিং অরোরা।
আর এই অবিস্মরণীয় মুহুর্তেই বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাঙালি জাতি পায় নিজস্ব লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত এবং বিশ্বের বুকে সগৌরবে দাড়িয়ে থাকা বহু কাঙ্কিত একটি মানচিত্র। রক্তাক্ত পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয় অর্জন ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা যখন বাংলাদেশে নির্বিচারে গনহত্যা শুরু করে, তখন বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি নারী-পুরুষ জীবন-ইজ্জত-আব্রু বাচাতেসীমান্ত পার হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়সহ সীমান্তঘেষা এসব রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় র্প্রাথী হয়। ঘরবাড়ি ছেড়ে যাওয়া এসব ভাসমান মানুষবানের পানির মত প্রতি মুহুর্তে জীবনের ঝুকি নিয়ে স্বদেশ ত্যাগ করে বাঁচার আশায়। রোগেশোকে , ক্ষুধায় যন্ত্রনাক্লিষ্ট এসব ভীতসন্তশ্র মানুষকে দীর্ঘ নয় মাসের সেই দুঃসময়ের দিনগুলিতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের মানুষ আর সেদেশের তৎকালীন সরকার আশ্রয় দান ও সর্বপ্রকার সাহায্যের মানবিক হাত প্রসারিত করেছিল। যার ফলশ্রুতিতেআজো বাংলাদেশের আপামর জন সাধারন বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। ভারতীয় উপমহাদেশে এত বিপু সংখ্যাক মানুষের গৃহত্যাগ ও অন্য দেশে শরণার্থী হওয়ার ইতিহাস ইতিপূর্বে আর কখনও লক্ষ্য করা যায় নি।
আত্নপ্রত্যয়ী বাঙ্গালী হিসেবে আমাদরে প্রত্যককেই সব সময় মনে রাখতে হবে, লাল সবুজের পতাকা আমরা সহজে অর্জন করতে পারিনি। এজন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। সাগরসম রক্ত ঝরাতে হয়েছে। মত সহস্র বছরের পরাধীনতার শৃঙ্গল ভেঙ্গে ১৯৭১ সালে বাংলার মানুষ এই দিনে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করে। সর্বশেষ যে পাকিস্তানি শোষকরা আমাদের পদানত করে রেখেছিল, তাদের সেই শৃঙ্গল ভাঙ্গার কাজটি সহজ ছিলনা। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের সাধারন নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলন, ৭০ এর নির্বাচন, ৭১এর অসহযোগ আন্দোলন সহ অনেক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আমাদরে সেই মুক্তির ক্ষেত্র তৈরী করে নিতে হয়েছিল। যে স্বপ্ন বুকে ধারন করে লাখ লাখ মুক্তিসেনা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশকে শত্রু মুক্ত করেছিলেন, স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলেন, আমরা তাদেরকে কখনই ভূলবনা ।
১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় তথা আমাদের কষ্টার্জিত এই অতিকাঙ্কিত মহান অর্জন একক কোন দলের, মতের, সম্প্রদায়ের, গোষ্ঠীর, ব্যক্তির নয়; এই বিজয় বাঙালী জাতির। এই মহান অর্জন প্রতিটি বাঙালী সবসময় বুকে ধারন করে বেচে আছে এর এর কোন প্রকার বিকৃতি ঘটুক তা জাতি কখনই প্রত্যাশা করেনা। আর সুপ্রাচীনকাল থেকেই এই ভূ-খন্ডের জনগণ সাহসিকতার সাথে বিভিন্ন সময় দীর্ঘ সংগ্রাম করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যুলুম-অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে, স্বৈরশাষনের বিরুদ্ধে, অগণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। প্রায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তারা সফল হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও আদর্শহীনতা যেভাবে বাসা বেধেছে, তাতে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে একটি আদর্শ ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে নির্মান করা রীতিমত অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে। তাই আজ বিজয়ের ৫০ বছর পর ভাবতে হবে আপমর জন সাধারনের কথা, তাদের আশা আকাঙ্কা ধারন করার কথা, তাদের ভাল-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা, প্রাপ্তি-প্রত্যাষা, দুঃখ বেদনা এবং বঞ্চনার কথা। স্বাধীনতাত্তোর ৫ দশকে হিংসা হানাহানি, প্রতিশোধ পরায়নতা, পরশ্রীকাতরতা, দলীয় কোন্দলের নোংরা খেলায় জাতিকে বিভাজনের মতো অসংখ্যা ব্যর্থতা স্পর্শ করেছে, তার গ্লানি দূর করার কথা। সামনের দিনগুলোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সার্বিক প্রস্তুতির কথা। তাহলেই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদা অকুন্ন থাকবে এবং তাদের সামনে আমরা গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে বলতে পারব আমরাই ঐক্যবদ্ধ সাহসী বীর বাঙালী। আর আমরা যদি অতীতের সকল হিংসা-হানাহানি, দলাদলি ভূলে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কাধে কাধ মিলিয়ে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন দেশ গড়ার কাজে আত্ননিয়োগ করি তবেই আমাদের পক্ষে সত্যিকার একটি সুখী সমৃদ্ধ আধুনিক বাংলাদেশ গড়া মোঠেই হবে না বলে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।