সিলেটের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সাংবাদিক অপূর্ব শর্মা

আনোয়ার হোসেন আনা:
প্রকাশিত হয়েছে : ২:৪৬:৩২,অপরাহ্ন ২০ অক্টোবর ২০১৯সিলেটের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র অপূর্ব শর্মা। তিনি একাধারে সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখালেখিতে অপূর্ব শর্মার নাম আজ অপরিহার্য। তাঁর লেখনির মাধ্যমে উঠে আসছে দেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনেক ইতিহাস। যে ক’জন ব্যক্তি দেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে অপূর্ব শর্মা অন্যতম। তার এই কর্মের জন্য স্বীকৃতিও অর্জন করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তাঁর প্রতিবেদন প্রকাশের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। যে বই গুলো দেশ বিদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানেও স্থান পেয়েছে। তার লেখা বইগুলোসহ বিভিন্ন প্রতিবেদন সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিতে সম্প্রতি চালু করা হয়েছে http://www.apurbasharma.com । বিশ্বের যেকোন প্রান্ত থেকে পাঠকরা তাঁর সবগুলো লেখা পড়তে পারবেন।
কলেজ জীবনে সাংবাদিকতায় আসা অপূর্ভ শর্মা তার লেখনির মাধ্যমে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ধারাবাহিক প্রতিবেদন এবং পরবর্তীতে গ্রন্থ রচনা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা তাকে অনেক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে।
অপূর্ব২ শর্মা ২০০৯ সালে সিলেট অঞ্চলের রাজাকারদের খুজে বের করে দৈনিক যুগভেরী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখেন-তুই রাজাকার’ সিরিজ। এতে অনেক যুদ্ধপারাধীর স্বরূপ উন্মোচিত হয়। এরপর থেকে অনেকটা ধারাবাহিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চাপা পড়ে থাকা ইতিহাস অনুসন্ধান করে চলেছেন তিনি।
অপূর্ব শর্মার উল্লেখযোগ্য ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলো হচ্ছে, ‘জগৎজ্যোতি’, ‘বীরাঙ্গনাদের কথা’, ‘মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের নারী’, ‘অস্তিত্ব সংকটে বধ্যভূমি’, ‘ওরা ফিরে আসেনি’, ‘সিলেটে যুদ্ধাপরাধ’, ‘চা বাগানে গণহত্যা’, ‘মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া মুখ’।
দেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে ক’জন গবেষক গবেষণা কাজ অব্যাহত রেখেছেন অপূর্ব শর্মা তাদের মধ্যে অন্যতম। এ পর্যন্ত অপূর্ব শর্মার প্রকাশিত ১৩টি গ্রন্থের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা রয়েছে ৮টিতে।
তার লেখা গ্রন্থগুলো হচ্ছে, ১. অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি (বইমেলা ২০০৯), সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২. সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র (বইমেলা ২০১০) ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ঢাকা, ৩. বিপ্লবী অসিত ভট্টাচার্য (বইমেলা ২০১০) ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ঢাকা, ৪. মুক্তিপথের অভিযাত্রী আমীনূর রশীদ চৌধূরী (বইমেলা ২০১১) সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ৫. অভিজাত গণতন্ত্রী আব্দুর রশীদ চৌধুরী (বইমেলা ২০১১) সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ৬. বীরাঙ্গনা-কথা (বইমেলা ২০১৩) সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ৭. মুক্তিযুদ্ধের এক অসমাপ্ত অধ্যায়: ফিরে আসেনি ওরা (বইমেলা ২০১৩), গদ্যপদ্য, ঢাকা, ৮. মুক্তিসংগ্রামে নারী (বইমেলা ২০১৪), শুদ্ধস্বর, ঢাকা, ৯. সাহিত্য সংস্কৃতি ও অন্যান্য (বইমেলা ২০১৬) হাওর প্রকাশন, সিলেট, ১০. মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর (বইমেলা ২০১৬), নাগরী প্রকাশন, সিলেট, ১১. সুরশব্দের ধ্রুবতারা (বইমেলা ২০১৬), হাওর প্রকাশন, সিলেট, ১২. চা-বাগানে গণহত্যা : ১৯৭১ (বইমেলা ২০১৬), সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৩. মুক্তিযুদ্ধে সিলেট জেলা, (বইমেলা ২০১৭), তাম্রলিপি, ঢাকা।
অপূর্ব শর্মার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা নিয়ে গবেষণা হয়েছে। ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ‘অপূর্ব শর্মার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা : প্রান্তজনের কথা’ শিরোনামে- সেমিনার আয়োজন করে। ‘অপূর্ব শর্মার জীবন কথা ও কর্ম পরিচয়’, ‘অপূর্ব শর্মার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা’ এবং ‘অপূর্ব শর্মার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণায় প্রান্তিক মানুষ’- এই তিন অধ্যায়ে বিন্যস্ত ছিলো সেমিনারটি। যৌথভাবে সেমিনার পেপার উপস্থাপন করেন প্রিয়াংকা বনিক, সাবরিনা আহমদ, আফসানা শারমিন ও সাহেদ আহমদ। সেমিনারের তত্ত্ববধায়ক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জফির উদ্দিন।
একই বছরের ১৭ মে তাঁর বিপুল প্রশংসিত চা-বাগানে গণহত্যা ১৯৭১ গ্রন্থের প্রকাশনা উপলক্ষে মদনমোহন কলেজ সাহিত্য পরিষদ ‘সবুজের রক্তগাথা’ নামে একটি প্রকাশনা স্মারক বের করে। স্মারকটি সম্পাদনা করেছেন মদনমোহন কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর অধ্যাপক আবুল ফতেহ ফাত্তাহ ও মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির পরিচালক (অর্থ) ও রবীন্দ্র গবেষক মিহিরকান্তি চৌধুরী। এই গ্রন্থে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক কামাল লোহানী, ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রবীন শিক্ষাবিদ লেখক, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর মো. আবদুল আজিজ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক লেখক-গবেষক অধ্যাপক নন্দলাল শর্মা, কবি ও গবেষক অধ্যাপক নৃপেন্দ্রলাল দাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা ড. সেলু বাসিত, সাবেক উপসচিব লেখক-গবেষক ড. শেখ ফজলে এলাহীসহ ১৮ জন লেখক মূল্যায়ন করেছেন অপূর্ব শর্মার কাজ।
২০১৮ সালে তাঁর লেখা ও গবেষণা থেকে আবৃত্তি ও পাঠের একক অনুষ্ঠান বীরাঙ্গনা কথার আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন শ্রুতি। এই সালের ১৫ ডিসেম্বর সিলেটের কাজী নজরুল অডিটরিয়ামে তাঁর লেখা থেকে আবেগঘন উপস্থাপনায় দর্শকদের আপ্লুত করেন প্রবাসে বাংলার মুখ খ্যাত জনপ্রিয় বাচিক শিল্পী মুনিরা পারভীন। এর আগে একই সালের ১৬ নভেম্বর মুনিরা পারভীনের নির্দেশনায় লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে মঞ্চস্থ হয় বীরাঙ্গনা দ্যা ওয়ার হেরোইন ১৯৭১। এতে অপূর্ব শর্মার প্রভারাণী ও সাফিয়ার আখ্যানের নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দেন মুনিরা। যা বাঙালি কমিউনিটিতে বিপুল প্রশংসিত হয়।
শুধু দেশেই নয়, প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যেও অপূর্ব শর্মা সমানভাবে সামাদৃত। লন্ডনের সাপ্তাহিক জনমত, আমেরিকার প্রথম আলো, কানাডার আশ্রম এবং ভারতের বিভিন্ন সাময়িকীতে নিয়মিত লিখে চলেছেন তিনি। যা একজন লেখক হিসেবে অপূর্ব শর্মাকে আসীন করেছে অনন্য উচ্চতায়।
সাংবাদিকতা এবং গবেষণা উভয় ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলা অপূর্ব শর্মা স্বীকৃতিও পেয়েছেন দুটি ক্ষেত্রেই। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণায় ২০১০ সালে তিনি লাভ করেছেন এইচএসবিসি কালি ও কলম তরুণ লেখক পুরস্কার এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাংবাদিকতায় ২০১৩ সালে দেশসেরা প্রতিবেদক হিসেবে অর্জন করেছেন বজলুর রহমান স্মৃতিপদক।
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখায় ২০১৫ সালে সিলেট মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্মাননা, ২০১৭ সালে ভারতের কলকাতার ভ্রমরা সম্মাননা, ২০১৮ সালে ত্রিপুরায় স্রোত সন্মাননা এবং শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাব সন্মাননা লাভ করেন তিনি। একই সালে সংগ্রামী নারীদের নিয়ে কাজ করায় সংবর্ধিত হন কলকাতায়। নারীবাদী সংগঠন আনন্দম ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর কলকাতায় তাঁকে এই সংবর্ধনা প্রদান করে।
১৯৭৯ সালের পহেলা মার্চ মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার হরিনাকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহন করেন অপূর্ব শর্মা। তাঁর পিতার নাম অতূল চন্দ্র শর্মা, মাতার নাম রাধা রাণী শর্মা। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।
কলেজ জীবনের (১৯৯৮) মৌলভীবাজার থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পাতাকুড়ির দেশ পত্রিকার আঞ্চলিক সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয় তাঁর। একই সময়ে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যুক্ত হন শ্রীমঙ্গল থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘খোলাচিঠি’ পত্রিকার সাথে। এর পর তিনি বিভিন্ন প্রত্রিকার শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এলাকার গন্ডি পেরিয়ে ২০০১ সালের আগস্ট মাসে তিনি সিলেট থেকে প্রকাশিত দৈনিক যুগভেরী পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি ওই পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক দায়িত্বে পেয়ে আজও দায়িত্ব পালন করছেন। যুগভেরীতে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে লেখার জন্য একটি বিশেষ মহলের চক্ষুশূলে পরিণত হন তিনি। ২০০৪ সালে দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকায় যোগদান করেন । ২০০৫ সাল থেকে বন্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আজকের কাগজের সিলেট অফিসের ব্যুরো চীফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও সাপ্তাহিক মৃদুভাষণ, সাপ্তাহিক ২০০০-এর বিভাগীয় প্রতিনিধি এবং নিউজ বাংলাদেশ ডটকমের ব্যুরো চীফের দায়িত্ব পালন করেছেন দক্ষতার সাথে। অনলাইন দৈনিক ‘শীর্ষ নিউজ’-এ ব্যুরো চীফ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।